শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.) এর জীবন ও সংগ্রাম
نَحْمَدُهُ وَنُصَلّى
عَلَى رَسُولِهِ الْكَرِيمِ اَمَّا بَعْدُ : فَقَدْ قَالَ اللَّهُ تَعَالَ
إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ وَقَالَ رَسُولُ اللهِ
صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْعُلَمَاءُ وَرَثَةُ الْأَنْبِيَاءِ
হযরত আয়শা সিদ্দীকা রা. পাঠাগার কর্তৃক
আয়োজিত অদ্যকার এই প্রতিযোগিতা মূলক বক্তৃতা মঞ্চের মান্যবর সভাপতি, বিজ্ঞ বিচারকমণ্ডলী, সুদক্ষ পরিচালক এবং আমার সামনে উপবিষ্ট
হযরত ছদর সাহেবের আদর্শে উজ্জীবিত সংগ্রামী বন্ধুরা!
পৃথিবীর ঊষালগ্ন থেকে অদ্যাবধি কালপরিক্রমার
বাঁকে বাঁকে বহু মহা মনীষীর আগমন ঘটেছে এ ধরণীতে। যাদের পদধুলির পরশে গৌরবান্বিত হয়েছে
বিশ্ব। যাদের ছিলোনা কোনো রাজসিংহাসন, ছিলোনা ধন-দৌলতের
মিথ্যা অহংকার। প্রভু প্রেমে যাদের অন্তর ছিলো পরিপূর্ণ। বাতিলের বিরুদ্ধে যারা আজীবন
সংগ্রাম করে গেছেন। যাদের আত্মত্যাগের বদলায় আমরা পেয়েছি আজকের ইসলাম। বহুকাল আগেই
তারা এধরণী ত্যাগ করেছেন ঠিক কিন্তু আজও লক্ষকোটি মানব হৃদয়ে তাদের স্মৃতি রয়েছে
চির অম্লান, চির ভাস্বর। সেই পূণ্যময় কাফেলার আলোকবর্তিকা
আজকের আলোচ্য ব্যক্তিত্ব মুসলিম মিল্লাতের উজ্জ্বল নক্ষত্র বাংলার গৌরব মুজাহিদে মিল্লাত
হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী (রহ.) প্রিয় সাথী ও বন্ধুগণ!
ক্ষণজন্মা এই মহা পুরুষ ১৮৯৮ খৃঃ এর ফেব্রুয়ারীতে
গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ার অন্তর্গত গওহরডাঙ্গার এক ঐতিহাসিক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ
করেন । কথায় বলে শিকারী বিড়াল গোঁফ দেখলেই চেনা যায় তাইতো তাঁর পিতা শৈশব থেকেই
বুঝতে পেরেছিলেন এ ছেলে একদিন ইসলামী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। তাই শত্রুদের
অস্ত্র দ্বারা শত্রুদের ঘায়েল করার জন্য তাকে ইংরেজী শিক্ষা দিতে থাকেন । তিনি প্রত্যেক
ক্লাশ অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হতে থাকেন এবং কলিকাতা আলিয়া মাদরাসার পার্শিয়ান
বিভাগে যা মুসলিম ছাত্রদের জন্য অত্যন্ত দুঃসাধ্য ছিলো সেখানে ভর্তি হয়ে অষ্টম শ্রেণীতে বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে স্বর্ণপদক লাভ করেন।
এভাবেই তিনি কৃতিত্বের সাথে জেনারেল শিক্ষা সমাপ্ত করেন। কিন্তু আল্লাহ তাআলা যার দ্বারা
দীনের বড় খিদমত নিবেন, তিনি তো এতটুকুর উপর সন্তুষ্ট থাকতে
পারেন না । তাইতো তার অন্তর কুরআন হাদীসের ইলমের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে । তখন তিনি
তার পিতার কঠিন আদেশ অমান্য করে থানভী রহ. এর সাথে পরামর্শ করে সাহারানপুর মাযাহেরে
উলূম মাদরাসায় ভর্তি হন । সেখানে ৪বছরে কাফিয়া হতে মেশকাত পর্যন্ত পড়েন সাথে সাথে
এ ৪ বছর প্রতি বৃহস্পতিবার ৩৫মাইল পায়ে হেঁটে থানাভবন যেয়ে রুহানী শিক্ষা লাভ করতে
থাকেন । অতঃপর ২ বছর দারুল উলূম দেওবন্দে সিহাহ সিত্তাহ পড়ার মাধ্যমে তার শিক্ষা জীবন
সমাপ্ত হয়। এ সময় তার প্রতিভার সৌরভ সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে হায়দারাবাদের বিচারপতির পদ গ্রহণের প্রস্তাব পান । কিন্তু ক্ষমতার মসনদ
তাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি, তাই তো তিনি জাতির খিদমতকে প্রাধান্য
দিয়ে অপসংস্কৃতির বেড়াজালে ঘুরপাক খাওয়া নিজ দেশের
মানুষকে সৎ পথের দিশা দিতে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন
করেন । শুরু করলেন বি-বাড়ীয়ার জামেয়া ইউনুসিয়ায় অধ্যাপনা। সেখানে দীর্ঘ পাঁচ বছর
অধ্যাপনা করেন । সাথে সাথে শিক্ষার আলো সারা বাংলায় বিস্তৃতি করতঃ বাংলাদেশ থেকে কুফর
বিদ'আত চিরতরে দূর করার লক্ষ্যে বিভিন্ন স্থানে বহু দীনি শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট
হন । তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ঢাকার বড় কাটারা আশরাফুল
উলূম মাদরাসা, জামিয়া ইমদাদিয়া ফরিদাবাদ, গওহরডাঙ্গা মাদরাসা এবং জামিয়া কুরানিয়া লালবাগের মত অত্যাধুনিক মাদরাসা। প্রিয়
সুখী।
শুধু তাই নয়, কুরআনের আলো সারা বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার জন্য তিনিই প্রথম বাংলা ভাষায় সঠিক
তথ্যবহুল অমর তাফসীর গ্রন্থ তাফসীরে হক্কানী রচনা করেন । তাছাড়া আজ তাবলীগী জামাতের
বিশ্বব্যাপী যে দাওয়াতী কার্যক্রম চলছে, বাংলাদেশে একাজের
সূচনা করে তিনি একজন স্বার্থক পথ প্রদর্শক হিসাবে চির স্মরণীয় হয়ে আছেন।
প্রিয় সাথী ও বন্ধুগণ!
রাজনৈতিক ময়দানেও তার অবদান কম নয়। কেননা
তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন এমন এক ঐতিহ্যবাহী বংশে যারা যুগ যুগ ধরে রাজনীতির ধারাকে
সচল করে রেখেছিলেন। তাইতো মজলুম জনগোষ্ঠী পেয়েছিলো শতাব্দির সেরা প্রতিবাদী এক কন্ঠস্বর।
খোদাদ্রোহী ও ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে এক আপোষহীন সৈনিক। তিনি বৃটিশ বিরোধী
আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন এবং এ আন্দোলনের
পথে যাতে কোনো বাধা সৃষ্টি না হয় এজন্য তিনি বড়কাটারা মাদরাসার অধ্যক্ষের দায়িত্ব
পীরজি হুজুরের নিকট ছেড়ে দিয়ে রাজপথে নেমে আসেন এবং সর্বাত্মক আন্দোলনে অংশ গ্রহণ
করেন । ১৯৪০ সালে ঐতিহাসিক সিমলা কনফারেন্সে এক জ্বালাময়ী ভাষণ দান কালে তিনি বলেন, হে জনগোষ্ঠী! তোমরা যদি নিজেদের ঈমান আমল নিয়ে বেঁচে থাকতে চাও তাহলে ইংরেজদের
বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়তে হবে এবং এদেশের মাটি থেকে ইংরেজদের চিরতরে
উৎখাত করতে হবে। এ সম্মেলনের পর তাকে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগের চেয়ারম্যান পদ
গ্রহণ করার অনুরোধ করা হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে পদমোহ ত্যাগী এক বিপ্লবী বীরের
ইতিহাস সৃষ্টি করেন ।
প্রিয় সাথী ও বন্ধুগণ!
শামছুল হক শুধু একটি নামই নয় একটি ইতিহাস, একটি বিপ্লব, ন্যায় নিষ্ঠার মূর্ত প্রতীক । অসত্যের
বিরুদ্ধে এক সাহসী সৈনিক। তাইতো জালিম আইউব খান যখন তাকে নিজ দলের সমর্থক বানানোর জন্য
৭০ লক্ষ টাকা দিতে চেয়েছিলেন তখন তিনি তেজোদীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন, “টাকা দিয়ে গরু-ছাগল কেনা যায়, কিন্তু শামছুল হককে
কেনা যায় না” । এমনিভাবে তিনি আইয়ূব সরকারের ইসলাম বিরোধী মুসলিম পারিবারিক আইনের
বিরুদ্ধে মার্শাল 'ল ভঙ্গ করে সভা সমাবেশ করতে থাকেন।
যখন তাকে বলা হল মার্শাল'ল ভঙ্গ করে আপনি কেন এসব করছেন? তখন তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেনঃ আমি তো মার্শাল'ল ভঙ্গ করিনি বরং তোমরা যেমন তোমাদের সরকারের হুকুম মেনে চলছ আমিও আমার সরকার আল্লাহর
আদেশ মেনে চলছি। এর কিছু দিন পরে তাকে গ্রেফতারের আদেশ দেওয়া হলে বাংলার গভর্নর আজম
খান তাকে গ্রেফতারে অপারগতা প্রকাশ করেন।
প্রিয় সুধী!
ফরিদপুরী (রহ.) মনে করতেন নিজেদের দীন ধর্ম
নিয়ে স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকতে হলে বাতিল শক্তির নিকট কখনোই মাথা নত করা যাবে না ।
তাইতো বাতিল শাক্তি যখনই মাথা চাড়া দিয়ে উঠত তখনই তিনি বাতিলের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান
গ্রহণ করতেন।
প্রিয় সাথী ও বন্ধুরা!
কি হতে পারে আজকের শিক্ষা সহজেই তা উপলব্ধি
করা যায়। আজ আবার সেই বাতিল শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, ফাঁদ পেতে হরণ করছে সরলমনা মুসলমানদের ঈমান-আকীদা। আকাশ সংস্কৃতি দ্বারা ধ্বংস
করছে ইসলামী শিক্ষা সংস্কৃতি ও তাহযীব-তামাদ্দুনকে
। সুতরাং আজ আর বসে থাকার সময় নেই, আমাদেরকে শামছুল
হক ফরিদপুরী (রহ.) এর জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে । ঈমানের দ্বীপ্ত মশাল নিয়ে
ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে । প্রয়োজনে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিতে হবে। বাতিল কে বুঝিয়ে দিতে
হবে মুসলিম কখনো মাথা নত করে না, করতে পারে না । তাহলেই
স্বার্থক হবে আজকের সেমিনার । أُولَئِكَ آبَائِي
فَجِثْنى
بِمِثْلِهِمْ * إِذَا جَمَعَتْنَا يَا جَرِيرُ الْمَجَامِعُ