মাতৃভাষার গুরুত্ব ও তাৎপর্য
(সামির আহমাদ)
হামদ ও সালাতের পর
উম্মাহাতুল মু’মিনিন রা. ছাত্রী
পাঠাগার কর্তিক আয়োজিত অধ্যকার বার্ষিক বক্তৃতা সেমিনারের মান্যবর সভাপতি, বিজ্ঞ-বিচারক মন্ডলী,
সু-দক্ষ্য পরিচালক ও আজকের সুধী। আপনাদের সকলকে জানাই আন্তরিক মোবারক বাদ,
সম্মানিত সুধী!
মায়ের ভাষায় কথা বলা মানুষের সহজাত অভ্যাস।
মাতৃভাষা মহান আল্লাহর অপার দান। এ ভাষা দিয়ে মানুষ নিজের মনের ভাবকে প্রকাশ করে। তাই
ইসলাম মায়ের প্রতি যেমন অকৃত্রিম শ্রদ্ধাবোধের শিক্ষা দিয়েছে, তেমনি মাতৃভাষার প্রতিও
অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছে। আর এর প্রতি লক্ষ্য রেখে মাতৃভাষার গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিষয়টি
নির্ধারণ করার জন্য বক্তৃতা সেমিনারের কতৃপক্ষকে জানাই আন্তরিক মোবারক বাদ।
সম্মানিত সুধী!
মহান আল্লাহ
সমস্ত নব ও রাসূলদেরকে স্ব-জাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছেন। যাতে তারা স্বীয়
জাতিকে দ্বীনের দাওয়াত স্পষ্টভাবে পৌঁছাতে পারেন।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ কোরআনে সূরা ইবরাহি্মের ৪ নং আয়াতে ইরশাদ করেন-
“আমি রাসূলগণকে তাদের স্বজাতির
ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি, যাতে তাদের (দ্বীন) স্পষ্টভাবে বুঝতে পারেন”
কোরআনুল কারীমের
এ আয়াত থেকে ইসলামের দৃষ্টিতে মাতৃভাষার গুরুত্ব প্রতিভাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্বীনের
পথে দাওয়াত দানকারীদের জন্য মাতৃভাষায় পারদর্শিতা অর্জনের নির্দেশনাও পাওয়া যায়। এ
বিষয়ে কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তালা আরও ইরশাদ করেন-
ادۡعُ اِلٰی سَبِیۡلِ رَبِّکَ
بِالۡحِکۡمَۃِ وَ الۡمَوۡعِظَۃِ الۡحَسَنَۃِ وَ جَادِلۡهُمۡ بِالَّتِیۡ هِیَ اَحۡسَنُ
অর্থ-“আপনি আপনার রবের পথে দাওয়াত দিন কৌশল ও উত্তম
ভাষণের মাধ্যমে”। সূরা নাহল: ১২৫
কোরআনের এসব বর্ণনা দ্বারা এ কথা বুঝতে বাকী থাকে না যে, স্বজাতিকে উত্তম
ভাষণের মাধ্যমে দাওয়াত দেওয়ার জন্য বিশুদ্ধ মাতৃভাষার ওপর পারদর্শিতা অর্জন
অনিবার্য।
প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আমি আরবদের
মধ্যে সবচে’ বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জলভাষী। ’ রাসূলের এ বাণী থেকে প্রমানিত হয়; বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জল মাতৃভাষায় কথা বলার
যোগ্যতা অর্জন করা রাসূল (সা.)-এর আদর্শ।
প্রিয় সুধী!
ফেরআউনকে যখন ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার লক্ষ্যে হজরত মুসা (আ.) কে আল্লাহ তালা
নির্দেশ দিলেন তখন তিনি নিজ ভাই হজরত হারুন (আ.) কে সঙ্গী হিসেবে পাওয়ার জন্য
আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন। এর এক মাত্র কারণ হজরত হারুন (আ.) খুব সুন্দর ও
স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতে ও বুঝাতে পারতেন। এ প্রসেঙ্গে কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তালা
এরশাদ হয়েছে- وَ اَخِیۡ هٰرُوۡنُ هُوَ اَفۡصَحُ مِنِّیۡ لِسَانًا
فَاَرۡسِلۡهُ مَعِیَ অর্থ- (হে প্রভূ) আমার ভাই হারুন আমার চেয়ে সুন্দর ও
স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারে। সুতরাং তাকে আমার সঙ্গে সাহায্যকারী হিসেবে প্রেরণ
করুন। –সূরা ক্বাসাস:
৩৪
সুতরাং এই আয়াত থেকে প্রতিয়মান হয় যে, মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও
যত্নবান হওয়া ঈমানি কর্তব্য।
সম্মানিত উপস্থিতি!
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠি যখন আমাদের
ভাষার অধিকার কেড়ে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল এবং
উর্দূকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল, তখন তাদের এই অপপ্রয়াসেকে রুখে
দেওয়ার জন্য বাংলাপ্রেমীরা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেছিলেন । এবং বাংলার
আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে ময়দানে ঝাপিয়ে পড়েন। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগানে মুখরিত করে তুলেন রাজপথ। এই দূর্বার
আন্দোলনে শামিল হয়ে মায়ের ভাষার জন্য বুকের তাজা রক্ত উৎসর্গ করেন এদেশের বহু
ছাত্র-জনতা।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সংগ্রামরত অবস্থায় পুলিশের গুলিতে নির্মমভাবে
শাহাদতবরণ করেন বরকত, সালাম, জব্বার, শফিক ও রফিকসহ নাম না জানা আরও অনেক বীর
সন্তানেরা। এভাবে মাতৃভাষার জন্য রক্তদান বা শাহাদত বরণের ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে
বিরল।
মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার দীপ্ত শপথে উৎসর্গকৃত তাজা রক্তের বদৌলতে
আমাদের মাতৃভাষা বাংলা রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি লাভ করে এবং রক্তে রঞ্জিত ২১ শে
ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদায় ভূষিত হয়।
প্রিয় সুধী!
আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা সৃষ্টিতে
মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনই প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করে। ভাষা আন্দোলনের
এই গৌরবোজ্জ্বল রক্তিম ইতিহাস জাতিকে অনুপ্রাণিত করবে যুগ থেকে যুগান্তরে, এটিই আমাদের প্রত্যাশা।
কিন্তু তিক্ত হলেও সত্য, যে লক্ষ্য, চেতনা ও আবেগ নিয়ে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল
আন্দোলনের এতো বছর পরও এই সময়ের সে চেতনার প্রতিফলন তথা মাতৃভাষা বাংলার ব্যবহার
সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠাত লাভ করেনি। যে আবেগ ও প্রেরণা নিয়ে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল অবস্থাদৃষ্টে
মনে হয় যেন, মাতৃভাষা বাংলার প্রতি নবপ্রজন্মের সেই ভালোবাসা নেই বলে মনে হচ্ছে।
হিন্দি সিনেমা ও সিরিয়াল দেখে শিশুরা হিন্দি কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে।
উচ্চবিত্তরা তাদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
এটিকে অনেকে এক ধরণের আভিজাত্য বলে মনে করছেন।
বাংলা ভাষার প্রতি এ রকম উদাসীনতা মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা ও ভাষা শহীদের
আত্মত্যাগকে স্পস্টতই অবমূল্যায়ন করার শামিল।
পরিশেষে আমি বলতে চাই!
তাই আসুন হে বাংলাপ্রেমীরা! ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত এই মাসে মায়ের
ভাষাকে ভিনদেশী আগ্রাসনমুক্ত করার শপথ নেই এবং ভিনদেশী ভাষাকে ফ্যাশন হিসেবে
ব্যবহারের প্রবণতাকে পরিহার করি । রুখে দাঁড়াই অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে। মাতৃভাষার
বিশুদ্ধ চর্চা ও প্রয়োগে সচেষ্ট হই এবং আল্লাহ প্রদত্ত এ নিয়ামতের জন্য মহান
আল্লাহর দরবারে শোকরিয়া আদায় করি।
সেই সঙ্গে যারা মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে শাহাদাৎবরণ করেছেন তাদের
রুহের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করি।
ওয়ামা আলাইনা ইল্লাল বালাগ!